‘এখনকার লেখার মধ্যে শৈল্পিকতা নেই’ : মোস্তফা মতিহার

সাংস্কৃতিক সাংবাদিকতায় পরিচিত মুখ সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা মতিহার। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখেছেন গান ও কবিতা। সম্প্রতি নিজের ব্যক্তিজীবন, সাংস্কৃতিক সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ট্রেন্ডিরিডার ডটকমের সঙ্গে বেশ খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: প্রথমেই জানতে চাই সাংবাদিকতা পেশায় আপনি সাংস্কৃতিক সাংবাদিকতার বিটকে কেন বেছে নিলেন?

মোস্তফা মতিহার: সংস্কৃতির প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার একটি বিশেষ ভালোলাগা আছে। একটি সময় আমি কবিতা লিখতাম, গান লিখতাম। ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে আমার লেখা গান বেশ কয়েকটি অডিও অ্যালবামে প্রকাশিত হয়। শুধুতাই নয়, ছোটবেলায় আমি বেশ কিছুদিন গানেরও তালিম নিয়ে নিয়েছিলাম। আসলে ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতি চর্চ্চা করতে করতে সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ থেকেই সংস্কৃতির প্রতি ধাবিত হয়ে পড়েছি।

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: আপনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে সাংস্কৃতিক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। যদি সাংস্কৃতিক সাংবাদিকতার সেকাল-একাল তুলনা করতে বলি, তাহলে এর গতিপথ কোনদিকে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

মোস্তফা মতিহার: আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার বিশ্লেষন হচ্ছে, নেতিবাচক ‍দিকে গিয়েছে।

আমার সাংবাদিকতার শুরুতে যখন আমি একটি লেখা লিখে জমা দিতাম তখন আমার মনে হতো আমি খুব ভালো লিখেছি। কিন্তু লেখা জমা দেওয়ার পরে যখন তা পাতার বিভাগীয় সম্পাদক আমার সেই লেখাটি সম্পাদনা করতেন তখন মনে হতো আমার আরো অনেক কিছু শেখার আছে। লেখার সময় বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন, বানান, সংবাদের ইন্ট্রো লেখার ধরন, সংবাদের বডি, লেখার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা, প্রুফ রিডিং ইত্যাদি কিভাবে করতে হবে তা আমাকে শিখতে হয়েছে।

কিন্তু এখন কিছু গতানুগতিক সাক্ষাৎকার টেলিফোনে নেওয়া হয়। যেখানে প্রশ্ন করা হয় আপনি কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বা এখন কি কাজ করছেন? এটা মোটেও সাক্ষাৎকার নয়, এটা আলাপচারিতা। আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার এক জিনিস নয়। একজন ভালো রির্পোটারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তিনি (সাক্ষাৎকারদাতা) যেটি বলতে চান না সেটাকেও বাহির করে আনা। সাক্ষাৎকারদাতার ভিতরের কথা বের করে আনাই হলো একজন সাক্ষাৎকার গ্রহীতার কারিশমা।

মূলত লেখা হচ্ছে এক প্রকার আর্ট। আর্ট যদি আর্টের মত না হয়, যদি গতানুগতিক লেখা হয়, যা পাতা ভরানোর জন্য আমি লিখলাম সেটা কোন লেখা না। আমি পাচঁশত শব্দ লিখলাম কিন্তু তা ভালোলাগলো না, হৃদয়গ্রাহী হলো না এতে কোনো লাভ নেই। কিন্তু আমি একশত শব্দ লেখতাম, যদি ঐ একশত শব্দ পাঠকে আকৃষ্ট করে তাহলে সেটাই স্বার্থকতা।

এখনকার লেখার মধ্যে শৈল্পিকতা নেই। এখন সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি সহজলভ্য বিষয় হয়ে গিয়েছে। এখন প্রতিযোগিতাও নেই।

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: সাংস্কৃতিক কিংবা বিনোদন সাংবাদিকতার পেশায় থেকে গীতিকার বনে যাওয়াকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মোস্তফা মতিহার: গান ইচ্ছে করলেই লেখা যায় না। সাহিত্যর সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে গীতিকবিতা। সাংবাদিকতা আর গীতিকবিতা এক জিনিস নয়। একজন গীতিকার ইচ্ছে করলেই কোন বিষয়ের উপর একটি ভালো রির্পোট লেখতে পারবেন না। কিন্তু যদি কিছু সাংবাদিকের ভিতরে গান লেখার তাড়না থাকে এবং তাদের ভিতরে সম্ভাবনাময়ী সৃজনশীলতা থাকে তাহলে তাদের মধ্যে কিছু কিছু লোক গান লেখার ক্ষেত্রে ভালো করেন। কিন্তু লেখতেই হবে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। জোর করে কাউকে দিয়ে গান, গল্প, কবিতা লেখানো যায় না।

ভিতর থেকে না আসলে কখনোই গান লেখা যায় না। কিন্তু যারা ফরমায়েশি কাজ করছেন সেখানে শিল্প পাওয়া যায় না। নিজের কিছু স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের জন্য অনেকেই এই কাজটি করেন যা উচিত না। যার যেই জায়গা তার সেই জায়গাতেই থাকা উচিত।  

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: আপনি নিজেও এক সময় গান লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিয়মিত হলেন না কেন?

মোস্তফা মতিহার: আমি শখের বসে গান লিখেছিলাম। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই আমি কবিতা লেখতাম। আমাদের সেই সময়টায় অনেকেই ডায়েরী মেইনটেইন করতো। সেই সময় আমি টুকটাক কবিতা লেখতাম। সেই কবিতা লেখার সুবাদেই সেসময় বেশ কয়েকজন গুনী গীতিকারের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। তখন তারাই আমাকে গান লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। তখন কয়েকটি গান লেখা হয়েছিলো।

কিন্তু পরবর্তীতে নিয়মিত না হওয়ার মূল কারণ ছিলো তখন আমার মনে হয়েছিলো আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করি, তাই আমার মূল জায়গাটা ঐটাই(সাংবাদিকতা)। আমি যদি সাংবাদিকতা পরিচয় বহন করার পাশাপাশি অন্য কোন কাজ করি তাহলে অন্যরা কিভাবে বিষয়টিকে দেখবেন কিংবা কেউ আমাকে বির্তকিত ভাববেন কিনা, মূলত নিজেকে বির্তক থেকে আড়ালে রাখার জন্য গান লেখা বাদ দিয়েছি।

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য কোন ধরনের কনটেন্ট নির্মাণ করা উচিত?

মোস্তফা মতিহার: নাটক, শর্টফিল্ম, সিনেমাসহ যে কোন ধরনের নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি ভালো গল্পের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। যখন একটি কনটেন্টে ভালো গল্প থাকে তখন দর্শকরা নির্মাণের ব্যাকরন না খুঁজে গল্পের ভিতরে ঢুকে যায়। তাই আমার মতে একজন নির্মাতা হচ্ছেন স্টোরি টেলার। হৃদয়ছোয়া একটি ভালো গল্পে দর্শকরা তাদের নিজের জীবনকে কখনো কখনো সেই গল্পে দেখতে পায়। তাই যে নির্মাতা যতবেশি ভালো গল্প বলতে পারবেন দর্শকদের কাছে তার গ্রহন যোগ্যতা ততবেশি হবে।

ট্রেন্ডিরিডার ডটকম: তারকা নির্ভর সাংবাদিকতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই..

মোস্তফা মতিহার: যেটা সাংবাদিকতার মধ্যেই পড়ে না সেটা নিয়ে মন্তব্য করার কিছুই নেই। কিন্তু তারপরেও বলছি.. তারকাদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য এটা একটা ভিন্ন ধরনের পন্থা। এটা সাংবাদিকতার পর্যায়ে কোনভাবেই পড়ে না। 

তানজিল আহমেদ জনি/৩ জানুয়ারি ২০২১/সাক্ষাৎকার/বিনোদন

You may also like...