‘এখন আমার বৃহস্পতি তুঙ্গে’ : রুমন
নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সরকারি তোলারাম কলেজে ইংরেজীতে অর্নাস পড়াকালীন সময়েই ভবিষতে চাকুরির বাজারে ইঁদুর দৌড় খেলার প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত না করে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নিজের অবস্থান তৈরির যুদ্ধে নেমে পড়েন স্বপ্নবাজ তরুণ রোমেনা আহমেদ রুমন। ২০১৫ সালে নিজের পকেট মানি দিয়েই ‘রুমন হ্যান্ডিক্র্যাফট কালেকশন’ এর যাত্রা শুরু করেন এই তরুণ তুর্কি উদ্যোক্তা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুঠোফোনে ট্রেন্ডিরিডারডটকমের তানজিল আহমেদ জনি এর সঙ্গে এক আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন তিনি।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসাটাকে কেন নির্বাচন করলেন?
রুমন: স্কুল জীবনে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রতি আমার একটা বিশেষ ভালোলাগা কাজ করতো। সেই সময় থেকেই ঈদ কার্ড, জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্ড, বিভিন্ন রঙের কাগজ কেটে ডেকোরেশন করতে আমার খুব ভালো লাগতো। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকেই নিজের অজান্তেই এই সৃষ্টিশীল পেশার সঙ্গে পথা চলা শুরু।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: ‘রুমন হ্যান্ডিক্র্যাফট কালেকশন’ নিজের নামেই কেন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করলেন?
রুমন: সাধারণত যেকোনা কাজের উৎসাহ একজন মানুষ তার পরিবার কিংবা সবচেয়ে কাছের কিংবা ভালোলাগার কিংবা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। কিন্তু আমার বেলায় ঘটেছে ঠিক উল্টো ঘটনা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মত সৃষ্টিশীল জগতে কাজ করার জন্য আমার পরিবারের কেউই আমাকে তাদের পক্ষ থেকে আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎসাহ দেয়নি। তাই আমি নিজের নামেই ‘রুমন হ্যান্ডিক্র্যাফট কালেকশন’ ফেইসবুক পেইজটি অবমুক্ত করে উদ্যোক্তা হিসেবেকাজ শুরু করি। যেহেতু আমার সামনে স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করার একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো, বলা যায় আমিও সেই চ্যালেঞ্জটা বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলাম।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: ২০১৫ সালে বছরের শেষ মাসে যাত্রা শুরুর পরে কেমন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মুখোমুখি হতে হয়েছিলো?
রুমন: হায়! বাঁধার কথা যদি বলি তাহলে তো মহাকাব্য লেখা সম্ভব। যখনই কেউ শুনতো আমি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করছি তখনই সবাই হাসতো। তখন আমি নিরব দশর্কের মত তাদের অভিব্যক্তি দেখতাম। প্রথমে একটু মন খারাপ হলেও পরে বেশ মজাই পেতাম। কারণ সেখান থেকে আমি আমার ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা লুফে নিতাম। তবে প্রথম থেকেই কিছু বন্ধু ছিলো যারা সব সময় আমাকে এই কাজে যথেষ্ঠ উৎসাহ দিয়েছে।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: মাঝে কিছু বছর তো গেলো। পরিবারের মনোভাব এখন কেমন?
রুমন: পরিবারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভাগ্যে শনির দশা একসময় থাকলেও এখন আমার বৃহস্পতি তুঙ্গে। কারণ বর্তমানে পরিবারের সবাই আমাকে বেশ সহযোগিতা করে।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: মূলত কোন বয়সের ও সমাজের কোন শ্রেণীর গ্রাহকদের জন্য কাজ করেন?
রুমন: ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজটাকে আসলে শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে ফেলে যাচাই করা যায় না। কারণ গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, গেট টুগেদার, অফিসিয়াল প্রোগ্রাম এগুলোতো সবার জীবনেরই অংশ। তাই সব বয়সের ও সমাজের সব শ্রেণির জন্যই নিয়মিত কাজ করা হয়ে থাকে।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: আপনার ফেইসবুক প্রোফাইল ঘেটে দেখা গেছে আপনি সংগঠন করতে খুব পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি নিজের বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করার সমন্বয় সাধন কিভাবে করেন?
রুমন: সহজ নয় তবে কঠিনও নয়। সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হলে নতুন নতুন পরিবেশে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ তৈরি হয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কাজের ক্ষেত্রে নেটওর্য়াকের আওতা প্রসারিত হয় অন্যদিকে নতুন নতুন বন্ধুও তৈরি হয়। এর ফলে আমি ভার্চূয়াল দুনিয়ার পাশাপাশি বাস্তব দুনিয়া কিংবা অফলাইন জগতেও বিভিন্ন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পাচ্ছি। তবে আমি টাইম ম্যানেজমেন্টের উপর ছোটবেলা থেকেই খুব বেশি জোর দেই। তাই আমার সামনে থাকা বিভিন্ন কাজের ধরণ অনুযায়ী সেই কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পাশাপাশি নিজের কাজগুলো সঠিকভাবে করার জন্য সময় বের করে নেই।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: আপনি কাজের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জকে ঘিরেই কেন থাকেন?
রুমন: এটা অনেক বড় বৃত্তান্ত। যদি একবার শুরু করি তাহলে আরব্য রজনীর মত নারায়ণগঞ্জের রজনী রচনা হয়ে যাবে। তাই স্বল্প কথায় বলছি। এস.এস.সি পরীক্ষার পরে হাতে যে তিন মাসের ছুটি ছিলো তখন আমি সেই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেই সময়ই আমি কিছুদিন বেশ কয়েকজনকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। তখন সেই কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগতো। শুধু তাই নয়, কেমন যেনো হৃদয়ে একটা স্বর্গীয় শান্তি পেতাম। সেই থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি যখনই স্বাবলম্বী হবো তখন থেকেই আমার এই নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষের জন্য কাজ করবো। তাই আমার সব পরিকল্পনা ও কর্মপরিধি শুধুমাত্র আমার প্রাণের শহর নারায়ণগঞ্জকে ঘিরেই।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: বর্তমানে ব্যবসা মূলত ফেইসবুক প্ল্যাটফর্মভিত্তিক। কাজের ক্ষেত্রে কেমন ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
রুমন: অনলাইনে কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পণ্যের আপলোড করা ছবি কিংবা যে কোনো কন্টেন্টের বিস্তারিত তথ্য মাত্র কয়েক মূহুর্তেই কপি হয়ে যায়। বলার সৎ সাহস থাকলে বলার উপায় নেই। কারণ কপি পেস্ট এমন অবস্থায় পৌছে গেছে যে, যারা কপি করছেন তাদের ভিতরে কোনো ধরণের লজ্জাবোধ বা অনুশোচনাও কাজ করছে না। যদি কাজের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও নীতি ঠিক থাকে তাহলে কাজ পাওয়া খুব কঠিন নয়। তবে আমার বেশিরভাগ কাজই সাধারনত রিপিট কাস্টমারদের কাছ থেকেই আসে।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: ফেইসবুকে লগইন করলেই চোখের সামনে শুধু ফেইসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তা নামক বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপের পেইজের নাম ভেসে বেড়ায়। যেখানে লাখ লাখ ফলোয়ার। আপনি এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?
রুমন: আসলে ফেইসবুকে উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক অসংখ্য গ্রুপ অনেক আছে। আমিও এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ফেইসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক গ্রুপে যুক্ত আছি। সব গ্রুপ যে কাজ করছে না তেমনটিও নয়। কিন্তু সমস্যা তখন হয় যখন গ্রুপকে বানিজ্য হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি লোভের কারণে যোগ্যদের দূরে ঠেলে অযোগ্যেদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পকেট গ্রুপ তৈরি করে নিজেরাই বিভক্ত হয়ে যায়। তখনই আসল বিপত্তিটা ঘটে। কারণ এতে গ্রুপের সাধারণ উদ্যোক্তারাও যেমনি একদিকে বিভ্রান্ত হয়, ঠিক অন্যদিকে তারা সংকোচ বোধ করে। ফলে তখন সবাই ভাবে অনলাইনভিত্তিক সব গ্রুপই বুঝি একই রকম।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: নেটিজেনদের কাছে আপনি ‘রুমন একা’ নামেই বেশি পরিচিত। ফেইসবুক আইডিতে নিজের এই নাম কেনো রাখলেন?
রুমন: বেলা শেষে সবাই একা। নিজের যুদ্ধ নিজেকেই করতে হয়। কিন্তু বিজয়ে পাশে থাকে সবাই। উদ্যোক্তা হিসেব পথ চলার প্রথম পদক্ষেপ থেকেই যেহেতু একলা পথ চলা শুরু করেছি তাই ইচ্ছে করেই ফেইসবুক আইডিতে নিজের নাম রুমন একা রেখেছি।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: তাহলে কি রুমন সংগ্রামী?
রুমন: আমি সংগ্রামী নাকি প্রতিবাদী নাকি নারাীবাদী তা নিজের আরশিতে নিজেকে এখনো দেখা হয়ে উঠেনি। তবে আমি শুধু জানি, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে যেতে হবে বহুদুর।
ট্রেন্ডিরিডারডটকম: ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
রুমন: আমাদের দেশের ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে অনেক প্রতিভাধর নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মেধা, যোগ্যতা, কাজ করার ইচ্ছে শক্তি থাকার পরেও নানা প্রতিকুলতার কারণে নিজেদের কর্মক্ষমতার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারছে না। আমি তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে চাই। কাউকে ঠকিয়ে নিজের বা নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম করতে চাই না। বড় বড় কথা বলে স্বপ্ন দেখাতেও চাই না।
ছবি সংগ্রহ: ফেইসবুক
তানজিল আহমেদ জনি/ জন/ লাইফস্টাইল/ ২৭ জানুয়ারি ২০২২